সরেজমিনে রামগতি ও কমলনগর: দেশ ভাসছে উন্নয়নে-আমরা ভাসছি মেঘনায়

আমার লক্ষ্মীপুর ডট কম, মাহমুদ ফারুক, ৫জুলাই:
সারাদেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে আর আমরা অসহায় মানুষ ভাসছি মেঘনায়। প্রতিদিনই ভাঙ্গছে মেঘনার পাড়। সর্বনাশী মেঘনা গিলে খাচ্ছে ঘরবাড়ী-ভিটেমাটিসহ মূল্যবান সম্পদ। বর্ষা না আসতেই ভাঙ্গণ তীব্রতর হচ্ছে। বর্ষা আসলে বর্তমান আবাসস্থলটিও তলিয়ে যাবে মেঘনার পেটে। একজন জনপ্রতিনিধিও ঘটনাস্থলে আসেননি। গত তিন বছরের অব্যাহত ভাঙ্গণের কবলে পড়ে রামগতি ও কমলনগর উপজেলার মেঘনার কোলঘেষে স্কুল-মাদ্রাসা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাঁটবাজার সব তলিয়ে গেছে মেঘনায়। হাজার হাজার মানুষ হারিয়েছে ভিটেমাটি।


বৃহস্পতিবার রামগতি উপজেলার বড়খেরী, আসলপাড়া, চরফলকন, সাহেবের হাঁটসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায় ভাঙ্গণ অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ এলাকার হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিনই বাস্তুহারা হচ্ছেন। বসতভিটা হারিয়ে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন রাস্তার পাশে। অনেকেই দেখা গেছে বসতভিটা ভেঙ্গে মালামাল অন্যত্রে নিয়ে যেতে। চারদিকে চলছে হাহাকার।
মেঘনার ভাঙ্গণ প্রতিরোধে কোন ব্যবস্থা না থাকায় স্থানীয়দের অভিযোগের কোন অন্ত নেই।
রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের লোকজনের সাথে কথার সাথে বাস্তবতার মিল খুঁেজ পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানান, সাবেক সাংসদ আবদুল্লাহ আলম মামুনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রামগতি থেকে কমলনগর উপজেলার মতিরহাঁট পর্যন্ত বেড়িবাঁধ নির্মিত হলেও কোন কারন ছাড়াই তা মাঝপথে থেমে গেছে।
স্থানীয় রামগতি ও কমলনগর এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বর্ষা আসতে না আসতে লক্ষ্মীপুরে মেঘনা ভয়াবহ ভাঙ্গন চরম আকার ধারন করেছে। হুমকির মুখে রয়েছে দুই উপজেলার ১০টি নতুন এলাকার হাজার হাজার মানুষের বসত বাড়িসহ মূল্যবান সম্পদ।


স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলায় ৯৬ কিলোমিটার বন্যা প্রতিরোধ বেড়ি বাঁধ রয়েছে। মেঘনার ভয়ঙ্কর থাবায় ইতিমধ্যে ৩৭ কিলোমিটার বেড়ি বাঁধ বিলীন হয়ে গেছে নদীগর্ভে। বর্ষা না আসতে রামগতি ও কমলনগর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নতুন করে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে কমলনগর উপজেলার সাহেবেরহাট, পাটওয়ারীরহাট, চরফলকন, মাতব্বরহাট, লুধুয়া ও রামগতি উপজেলার বাংলা বাজার, আসলপাড়া, গাবতলী ও বড়খেরীসহ ১০টি এলাকার প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা। হুমকির মুখে রয়েছে রামগতি ও কমলনগর উপজেলা পরিষদ, হাসপাতাল, আলেকজান্ডার বাজার ও সরকারী বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বসত বাড়ি, ফসলি জমিসহ গুরুত্বপূর্ন স্থাপনা ও সম্পদ। মেঘনার ভাঙ্গণে ইতিমধ্যে কয়েক হাজার মানুষ ঘর বাড়ি হারিয়ে রাস্তার পাশে খুপড়ি ঘর তুলে মানবেতর জীবন যাপন করছে। নতুন করে বসতবাড়ি হারিয়ে ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে খোলা আকাশের নিছে।
এবার বর্ষার শুরুতেই ফের ধস দেখা দেওয়া আতঙ্কে রয়েছে দু-লক্ষাধিক মানুষ। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু না হওয়ায় বাঁধের দু’পাশের এলাকায় অব্যাহতভাবে ভাঙছে। অনিয়মের মধ্য দিয়ে নিন্মমানের কাজ করায় বারবার বাঁধে ধস নামছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। তাই দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহবান জানান স্থানীয় এলাকাবাসী।
বেড়ি বাঁধ রক্ষা ও ভাঙ্গন প্রতিরোধের দাবীতে প্রতিদিনই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী, মানববন্ধন বিক্ষোভ সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসুচি পালন করে আসছে। বিভিন্ন সংগঠন মেঘনার ভাঙ্গণ প্রতিরোধে সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন বিভিন্ন মাধ্যমে।
রামগতির আলেকজান্ডার বাজারের আংশিক হয়ে কমলনগর উপজেলার মতিরহাট হয়ে মজু চৌধুরীর হাট পর্যন্ত দ্রুত বেড়ি বাঁধ সংস্কার করে রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় বসবাসকারী লক্ষ জনতার স্বপ্নসাধ ও বসত বাড়ি রক্ষা করার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবী জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
স্থানীয় ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ লিটন জানান, আগের সাংসদ এ এলাকার নদী ভাঙ্গণ প্রতিরোধে ব্যপক কাজ করলেও বর্তমানে সাংসদ বিকল্পধারার নেতা মেজর (অবঃ) আবদুল মান্নান একবারের জন্যও সংসদে মেঘনার ভাঙ্গণ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে কোন ভূমিকা রাখেনি। উপরুন্ত বর্তমান সাংসদ মেজর মান্নান নিজেই কোটি কোটি টাকার মামলায় দুদকে হাজিরা দিতে এখন ব্যস্ত। আমাদের আল্লাহ ছাড়া কোন উপায় নেই। সারাদেশ বর্তমান সরকারের আমলে উন্নয়নে ভেসে যাচ্ছে, আর আমরা কমলনগরবাসী ভাসছি মেঘনায়।
ভাঙ্গণের কবলে সর্বস্ব হারিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কমলনগর উপজেলার সাহেবের হাঁট এলাকার আবু তাহের নামের এক কৃষক জানান, আমার সব শেষ হয়ে গেছে। দু-চারদিন মধ্যে হয়তো ভিটিমাটি ছেড়ে চলে যেতে হবে অন্যত্রে। কয়েক একর সম্পত্তি ইতোমধ্যে মেঘনার ভাঙ্গণে তলিয়ে গেছে। পরিবার পরিজন ও স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে কোথাও যাবো। চেয়ারম্যান মেম্বার কি করবেন, স্থানীয় এমপি সাহেবও নির্বাচনের পর এলাকায় আসেননি।
রামগতি উপজেলা চেয়ারম্যান শরাফ উদ্দিন আজাদ জানান, নদী ভাঙ্গন বিষয়ে স্থানীয় সাংসদ সংসদে কথা বলেছেন। বড় ধরনের একটি বরাদ্ধ আমরা শীগ্রয় পেতে যাচ্ছি। ভাঙ্গণের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে আমরা সরকারীভাবে গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তর করছি। ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা করা হচ্ছে, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা অনুযায়ী সরকারী সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার রফিক উল্যাহ জানান, রামগতি ও কমলনগর উপজেলার ৪টি ইউনিয়নেই বেশি ভাঙ্গণ উল্লেখযোগ্য। কয়েকস্থানে নতুন করে ভাঙ্গণ দেখা দিয়েছে। বর্ষা আসলে তা আরো বেশি হবে। ক্ষতিগ্রস্থদের সরকারীভাবে আশ্রয়ন প্রকল্পে বা গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তরের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। চর পোড়াগাছা ও চরবাদাম ইউনিয়নের সরকারী খাস জমিতে আমরা বর্তমানে ভূমিহীনদের জমি বরাদ্ধের ব্যবস্থা করেছি। তেলিরচর ১ ও তেলিরচর ২ এ আমরা আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরি করেছি। আলেকজান্ডার বেড়িবাঁধটি সম্প্রসারন করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। বরাদ্ধ পাওয়ার সাথে সাথে কাজ শুরু হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

Source Link: দৈনিক বার্তা

Facebook 0
Google+ 0
Twitter
LinkedIn 0
Pinterest 0
Close Menu