লক্ষ্মীপুরে তিন ধাপে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে মেঘনা নদীর ৩৫ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয় ২০১৩ সালের শেষ দিকে। তবে এখন পর্যন্ত প্রথম ধাপে মাত্র ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণের কাজ শেষ হয়েছে। কাজের এ ধীরগতির কারণে মেঘনার অব্যাহত ভাঙনে বাস্তুহারা হচ্ছে পাড়ের মানুষ। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ায় এ ভাঙন আরো তীব্র হয়ে ওঠার আশঙ্কা করছে তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, মেঘনা নদীর ভাঙন থেকে লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলাকে রক্ষার জন্য তিন ধাপে ৩৫ কিলোমিটার তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজের জন্য ২০১৩ সালের শেষ দিকে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। প্রথম ধাপে ২০১৪ সালে লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় মেঘনা নদীর ভাঙন প্রতিরোধে ১৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। এর অধীনে রামগতিতে সাড়ে চার কিলোমিটার ও কমলনগরে এক কিলোমিটার তীর রক্ষাবাঁধ নির্মাণ করা হয়। তবে ভাঙন প্রতিরোধে প্রথম পর্যায়ের সাড়ে পাঁচ কিলোমিটারের কাজ অপর্যাপ্ত হওয়ায় তা আরো ৯০০ মিটার বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। প্রকল্প অনুযায়ী দ্বিতীয় ধাপে কমলনগর উপজেলার (মতিরহাট থেকে চর ভয়া) আট কিলোমিটার ও রামগতি উপজেলায় সাড়ে সাত কিলোমিটার এবং বাকি ১৪ কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষা বাঁধ তৃতীয় ধাপে নির্মাণ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে দ্বিতীয় ধাপ অনুমোদন না হওয়ায় প্রকল্পের কাজ এ অবস্থায় থমকে আছে।
স্থানীয়রা জানায়, নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে বিলীন হয়ে গেছে কয়েক হাজার বসতবাড়ি, সাত হাজার একরেরও বেশি ফসলি জমি, ১৫টি হাটবাজার, ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ ৩৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। তীর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হলেও কাজের ধীরগতির কারণে নদীর ভাঙন অব্যাহত আছে। এতে মাতাব্বরহাট, সাহেবের হাট, লুধুয়া বাজার, আসলপাড়া ও জনতাবাজারসহ বিস্তীর্ণ জনপদ ও কমলনগর উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। এছাড়া প্রথম ধাপে কমলনগরে নির্মিত বাঁধও ভাঙতে শুরু করেছে। গত দেড় বছরে এ বাঁধে আটবার ভাঙন দেখা দিয়েছে।
নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে পাঁচবার আবাসস্থল পরিবর্তন করতে হয়েছে কমলনগর উপজেলার সাহেবের হাট ইউনিয়নের এক সময়ের অবস্থাসম্পন্ন কৃষক কামাল হোসেনকে। সর্বস্ব হারিয়ে পরিবার নিয়ে তিনি এখন অন্যের ঘরে আশ্রিত। তিনি বলেন, কমলনগর উপজেলার ১৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মেঘনা নদীর অবস্থান। সবদিক দিয়েই মেঘনা নদী ভাঙছে। বর্ষা শুরু হওয়ায় ভাঙন আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
সাহেবের হাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল খায়ের বলেন, নদীর ভাঙনের কারণে এই ইউপির কার্যালয় চারবার স্থানান্তর করতে হয়েছে। কয়েক বছরে নদীর ভাঙনে এ ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ড, পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক স্কুল, একটি দাখিল মাদ্রাসা ও দুটি আলিম মাদ্রাসা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তিন ওয়ার্ডের ১০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে।
চর কালকিনি ইউপি চেয়ারম্যান সাইফ উল্যাহ জানান, মেঘনা নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে এ ইউনিয়নের দুটি ওয়ার্ড ও পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হয়েছে। দ্রুত বাঁধ নির্মাণ না হলে এ ইউনিয়নের পুরোটাই নদীগর্ভে তলিয়ে যাবে।
দ্রুত বাঁধ নির্মাণের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন ও সড়ক অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে ‘কমলনগর-রামগতি বাঁচাও মঞ্চ’ নামের একটি সংগঠন। সংগঠনটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার পলোয়ান বলেন, গত ২০ বছরে মেঘনা নদীতে এ অঞ্চলের অর্ধেক এলাকা বিলীন হয়ে গেছে। দ্রুত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর চ্যানেল পরিবর্তন এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের পাশাপাশি কমলনগর উপজেলাকে রক্ষায় দ্রুত বাঁধের কাজ শুরু করা হোক। অন্যথায় কয়েক বছরের মধ্যে কমলনগর উপজেলা দেশের মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীপুর পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন বলেন, দ্বিতীয় পর্যায়ে তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা (ডিপিপি) প্রস্তুত করার জন্য ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার এলাকার সার্ভে করা হয়েছে। সার্ভে রিপোর্টের পর ডিজাইন ডাটা বা নকশা প্রস্তুত করে প্রাক্কলন তৈরি করে ডিপিপি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। প্রকল্পটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমোদন পেলে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে।
গত ১২ এপ্রিল মেঘনার ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। কাজের ধীরগতি সম্পর্কে ওইদিন এক পথসভায় তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ে প্রসেসিং করতে একটু সময় লাগে। তবে রামগতি-কমলনগর এলাকায় প্রয়োজনে বিশেষভাবে কাজ করা হবে। নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণে সরকার আন্তরিক। বর্ষায় উপকূল অঞ্চলের মানুষকে আতঙ্কে না থাকার জন্যও আশ্বাস দেন তিনি।
Source Link: দৈনিক বার্তা